ইরান ও ইসরাইলের সম্পর্ক বর্তমান সময়ে উত্তেজনাপূর্ণ ও সংঘাতমুখী। কিন্তু এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে শত্রুতার শেকড় কোথায়? ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে কি নতুন এক বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি করছে? এই নিবন্ধে আমরা ইরান ও ইসরাইলের সম্পর্কের পুরনো ইতিহাস এবং বর্তমান সংঘাত নিয়ে আলোচনা করবো, পাশাপাশি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা কতটা বাস্তব সে বিষয়টিও বিশ্লেষণ করবো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটে। ব্রিটিশ ও ফরাসি উপনিবেশের প্রভাব থেকে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন, সবকিছুই এই অঞ্চলের মানচিত্র নতুন করে সাজায়। ইরান, যদিও সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়নি, তবুও যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে।
অন্যদিকে ইসরাইল তখনো একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না। ব্রিটেনের অধীনে থাকা প্যালেস্টাইন অঞ্চলে ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছিল। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর সাথে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। তখন ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সরাসরি শত্রুতা দেখা না গেলেও, এই অঞ্চলের সামগ্রিক ক্ষমতার ভারসাম্যের উপর তাদের প্রভাব পরোক্ষভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী পরিপ্রেক্ষিত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরাইলের রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া জোরদার হয়, আর সেসময় ইরান কিছুটা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে আরব দেশগুলোর সাথে ক্রমাগত যুদ্ধবিরোধী মনোভাব ইরানের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে। ইরান তখনো পশ্চিমা দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে অবস্থান করছিল, কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৭৯ সালের ইরানের বিপ্লব ইরানের পররাষ্ট্র নীতিতে আমূল পরিবর্তন আনে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে সরাসরি শত্রুতা শুরু করে।
ইসলামি বিপ্লব ও তেহরান-তেল আভিভ সম্পর্কের অবনতি
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান ও ইসরাইলের সম্পর্ক দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। ইরান ইসরাইলকে “শয়তানের রাষ্ট্র” বলে আখ্যায়িত করতে শুরু করে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ইরান সরাসরি সমর্থন দেওয়া শুরু করে। ইসরাইলি সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে ইরান প্রতিনিয়ত বক্তব্য দিয়ে আসছে এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে সমর্থন প্রদান করছে। এই শত্রুতার কারণ মূলত ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং আঞ্চলিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।
আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াই
মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যে ইরান ও ইসরাইলের দ্বন্দ্ব মূলত প্রভাব বিস্তার এবং রাজনৈতিক স্বার্থে কেন্দ্রিক। ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলে ইসরাইল তার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অবস্থান নেয়। ইরান মনে করে, ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। অন্যদিকে, ইসরাইল মনে করে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি।
সিরিয়া ও লেবানন
ইরান ও ইসরাইলের মধ্যকার বর্তমান সংঘাতের বড় অংশ সিরিয়া ও লেবাননে কেন্দ্রীভূত। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় ইরান সিরিয়ার আসাদ সরকারের সমর্থন দেয় এবং হিজবুল্লাহসহ শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীকে সহায়তা করে। ইসরাইল একাধিকবার সিরিয়ায় ইরানি অবস্থানের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা কি বাস্তব?
ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান শত্রুতা শুধুমাত্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, এটি পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বের স্থিতিশীলতাকেও প্রভাবিত করছে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এবং ইসরাইলের প্রতিরক্ষা কৌশল দুটি দেশকে ক্রমশ যুদ্ধের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। যদিও দুই দেশ সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি, তবে আঞ্চলিক সংঘাত ক্রমশ বৈশ্বিক মহাসংকটে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আঞ্চলিক সংঘাত থেকে বৈশ্বিক যুদ্ধ
মধ্যপ্রাচ্য বরাবরই আন্তর্জাতিক কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যে কোনো সামরিক সংঘাত বিশ্বের অন্যান্য বড় শক্তিগুলোকেও আকৃষ্ট করবে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো শক্তিগুলোর ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সংঘাত বড় আকার ধারণ করে, তাহলে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করতে পারে।
পারমাণবিক হুমকি
ইরান ও ইসরাইলের মধ্যকার সংঘাতকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম বড় কারণ পারমাণবিক অস্ত্র। ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয় এবং ইরান তার নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো এক পক্ষ যদি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে, তবে তা বৈশ্বিক বিপর্যয়ের সূচনা করতে পারে।
ইরান ও ইসরাইলের শত্রুতার শিকড় ইতিহাসে অনেক গভীরে নিহিত। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্য বারবার পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে শত্রুতার জন্ম হয়েছে। যদিও এখনো সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয়নি, তবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করছে। এখনই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়, তবে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ এবং কূটনৈতিক সমাধান না এলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংঘাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।